করোনাভাইরাস

মহামারি মোকাবিলায় অর্জন ধরে রাখতে হবে

বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও অভাবনীয় একটা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, দ্রুততম সময়ে টিকা তৈরি, ভাইরাসের সঙ্গে মানিয়ে বাঁচতে শেখা—এসব কারণে মহামারির দুঃসহ অভিজ্ঞতা ও মৃত্যুশোকের ভয়াবহতা এখন অনেকটাই পেছনের বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) জারি করা স্বাস্থ্যগত বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ঘটনা সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওই বছরের ১১ মার্চ করোনাকে মহামারি ঘোষণা করে সংস্থাটি। তিন বছরের বেশি সময় পর ৫ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যগত বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী প্রথম শনাক্ত হয়।

প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণার পর করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের গঠন করা করোনাসংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি কিছু সুপারিশ দিয়েছে। এর মধ্যে করোনাকালে স্বাস্থ্য বিষয়ে অর্জনগুলো ধরে রাখা, করোনার টিকাকে জাতীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার পাশাপাশি করোনাসংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। কারিগরি কমিটির সুপারিশ মূল্যায়ন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবে বলে আমরা আশা করি।

করোনা মহামারির ধাক্কায় সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে তছনছ করে দেয়। ধনী দেশগুলো তাদের বিশাল সম্পদ দিয়েও একেবারে শুরুর দিকে অভাবনীয় এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকটাই ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, স্বল্প সম্পদ, ভঙ্গুর ও অপ্রতুল স্বাস্থ্য অবকাঠামো এবং বৈষম্যপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবার দেশে মহামারি মোকাবিলার চ্যালেঞ্জ ছিল পর্বতপ্রমাণ।

ভুলভ্রান্তি, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির অভিযোগের পরও সামগ্রিক বিচারে করোনা মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভালো করেছে। বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময়োচিত পদক্ষেপ নেওয়ায় সেটা সম্ভব হয়েছে।

অপ্রতুল চিকিৎসা ও সুরক্ষা উপকরণ নিয়ে মহামারির পুরো সময়টাতে চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যসেবাকর্মীরা যে অনন্য সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন, তাতে এই মহামারি মোকাবিলায় তাঁরাই প্রকৃত বীর। তাঁদের অনেকে জীবনও দিয়েছেন। নানা সীমাবদ্ধতার পরও করোনার টিকা দেওয়া ও এর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। প্রথম দিকে টিকার অনিশ্চয়তা থাকলেও পরে নানা উৎস থেকে টিকা পাওয়া যায়। নানা গুজব ও অপপ্রচার সত্ত্বেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকা নিয়েছে।

বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে অর্থনীতি সচল রাখার চ্যালেঞ্জটা ছিল আরও গভীর ও বহুমুখী। সিংহভাগ কর্মসংস্থান অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে হওয়ায় করোনার বিধিনিষেধে কাজ হারান অসংখ্য মানুষ। নতুন করে কয়েক কোটি মানুষ দরিদ্র হয়।

সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে কঠিন সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানাসহ ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালু করায় সংকটটা আরও ব্যাপক হতে পারেনি। স্থবিরতা কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিও এখন পুনরুদ্ধারে পথে রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন অভিঘাতে চ্যালেঞ্জটা আরও ব্যাপক হয়েছে। মহামারির অনেক বেশি প্রভাব পড়েছে শিক্ষায়। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার বাস্তব কোনো সমাধান এখনো দৃশ্যমান নেই।

এটা আমাদের জন্য আনন্দের যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার একমাত্র শিক্ষা এই মহামারি আমাদের সামনে রেখে গেছে। মহামারিতে স্বাস্থ্য খাতে যে অর্জন, তা ধরে রেখেই স্বাস্থ্য অবকাঠামোকে ঢেলে সাজানো ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আর কোনো বিকল্প নেই। মহামারি প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখনই আগাম প্রস্তুতি না নিলে ভবিষ্যতের মহামারির আরও বড় বিপর্যয় এড়ানো যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *